Wednesday, August 2, 2017

“গোধূলি লগ্নে লোহিত সাগরের তীরে...।”

সময় কত দ্রুত চলে যায়। এইতো সেদিন রাজধানী রিয়াদের পিচঢালা পথে হেঁটে বেড়িয়েছে আনমনে। জেদ্দায় এসেছি প্রায় সপ্তাহ খানেক দিন হয়ে গেলো। কিন্তু নগরটাকে তেমন করে ঘুরে দেখা হলোনা। ‘মক্কার প্রবেশদ্বার’ খ্যাত এই নগরীতে আধুনিকতা ও প্রাচীনতা চমৎকারভাবে মিশে আছে। অনেক ভবনেই রাজসিক নকশার উপস্থিতি পাওয়া যায়। আলোর প্রতিফলনে চকচকে কাঁচের দেয়াল, স্টিলের কাঠামো, বিভিন্ন রকমের বর্ণিল মার্বেল পাথরের স্থাপত্য, নকশাখচিত উজ্জ্বল অট্টালিকাসমূহ চলতি পথেই মুগ্ধ করে তোলে।

আমি একাকী আনমনে...।

রুমে এক বড় ভাইকে লোহিত সাগরের কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি জানান যে, এখান থেকে সমুদ্দুর খুব নিকটেই। দেখার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতেই সাথে সাথে প্রস্তুত হওয়ার কথা বলেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে তৈরি হয়ে মুছনা বাজার থেকে ট্যাক্সি ক্যাবে করে প্রায় পনেরো মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই লোহিত সাগরের তটে। সমুদ্রের বেলাভূমে দাঁড়িয়ে গোধূলি লগ্নে সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য সত্যিই সাহিত্যের আশ্রয়ে বর্ণনাতীত।

সূর্যাস্তের দৃশ্যপট। 

পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত সমুদ্র সৈকত। কর্মব্যস্ত জীবনের অবসরের মুহূর্তগুলোকে আনন্দময় করতে প্রিয়জনদের নিয়ে সাগর তীরে বসেছে মানুষের মিলনমেলা। আনন্দঘন এ মুহূর্তটাকে ক্যামেরায় বন্দী করতে অনেকেই ব্যস্ত। কী অপূর্ব উচ্ছল ঢেউ, পাথর-সিমেন্টে বাঁধাই করা পাড়ে বড় বড় পাথরের ওপর ঢেউ আছড়ে পড়ে, সফেদ জলকণা উড়ে এসে বৃষ্টির ছাঁটের মতো দর্শনার্থীদের ভিজিয়ে দেয়।

লোহিত সাগরের উপকূল থেকে ধারণকৃত ভিডিও ক্লিপ। 

লোহিত সাগর (Red Sea) ভারত মহাসাগরের একটি অংশ, যা আফ্রিকা ও এশিয়া মহাদেশকে পৃথক করেছে। সাগরটির দক্ষিণে বাব এল মান্দেব প্রণালী ও ইডেন উপসাগরের মাধ্যমে ভারত মহাসাগরের সাথে যুক্ত হয়েছে। সাগরটির উত্তরাংশে সিনাই উপদ্বীপ, আকাবা উপসাগর এবং সুয়েজ উপসাগর অবস্থিত। বাষ্পীভবন ও বায়ুপ্রবাহের ফলে উদ্ভূত জলপ্রবাহের বিন্যাসজনিত কারণে লোহিত সাগর বিশ্বের সবচেয়ে লবণাক্ত সাগরগুলির একটি। এই সাগরের লবণাক্ততা ৩.৬% থেকে ৩.৮%। লবণাক্ত এই সাগরের দৈর্ঘ্য ১৯০০ কিঃ মিঃ এবং সর্বাধিক ৩০০ কিঃ মিঃ প্রশস্ত। এর মোট আয়তন ১ লাখ ৭৪ হাজার বর্গকিলোমিটার। লোহিত সাগরের গড় গভীরতা প্রায় ৫০০ মিটার এবং সর্বোচ্চ গভীরতা ২,৫০০ মিটার।

লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত আর-রাহমাহ (ভাসমান) মসজিদটি স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমার মনে হয় কখনও কখনও সমুদ্রের কাছে এলে মানুষের মন এলোমেলো হয়ে যায়। বিক্ষিপ্ত মনের অতলে তখন কতশত ভাবনা যে উঁকি দেয়। সমুদ্রের ঢেউ দেখে কেউ হয় রোমান্টিক, কেউ হয় নস্টালজিক, কেউ হয় কাব্যিক, কেউবা হয় আনন্দে আত্মহারা। সাগরতীরে এসে কেউ থাকে মধুচন্দ্রিমা মুডে, কেউ থাকে অবকাশ যাপন মুডে, আবার কেউবা স্মৃতির গহীনে হাতড়ে বেড়ায় পেছনে ফেলে আসা সময়গুলোকে। আর এই আমি সৃষ্টিকর্তার অপূর্ব সৃষ্টির সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কৃতজ্ঞতায় বার বার আবেগাপ্লুত হচ্ছিলাম….

সমুদ্র তীরে সালাত আদায়ের জন্য এ রকম মাদুর বিছানো থাকে। 

“সাগরের সৈকতে…. কে যেন দূর হতে…..
আমারে ডেকে ডেকে যায়…. আয় আয় আয়….
পারি না তবু যেতে…. শিকল বাঁধা এ দু’টি পায়….।”

মানুষের এক জীবনের পুরোটাই তো নিয়তির অমোঘ শেকলে বাঁধা। এই বাঁধন ছিন্ন করে কেউ কেউ বেরিয়ে আসতে পারে, আবার কেউ পারে না….।

Sunday, June 25, 2017

“প্রবাসে ঈদ : বিষণ্ন মনের প্রচ্ছন্ন অশ্রু বিসর্জন।”

খানিক সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি, ঈদকে নিয়ে কী লিখবো তাই ভেবে! তবুও কিছু একটা লিখতে হবে ভেবেই লিখা। ফেবুতে খুদেবার্তা পেলাম ঈদ নিয়ে লিখার জন্য। যিনি লিখতে বলে মেসেজ করেছেন তার ভালো লাগায় আবদ্ধ আমি এই অযোগ্য মানুষটা। তাই আর অনুরোধ উপেক্ষা করার সাহসে সাহসী হইনি। কিন্তু লিখতে বসে যে শব্দাভাবে ভুগছি তা কী করে এই প্রিয় মানুষটাকে বলি?

খুবই শংকিতভাবেই কী-বোর্ডে হাত চালাতে শুরু করলাম। আর ভাবনার চোখ দিয়ে প্রবাসের ঈদকে হৃদয়ঙ্গম করতে গিয়ে ব্যাথাতুর নেত্রদ্বয় জলভারে ভারী হচ্ছিলো। প্রবাসের অপূর্ণাঙ্গ ঈদের কথা উপস্থাপনে বার বার পিছনে ফিরে যেতে হয়েছে আমার শ্যামলিয়ায়। আমার মাতৃভূমিতে। যেখানে ঈদ আনন্দ উপছে পড়ে খুশির ফোয়ারা হয়ে! প্রবাসে সবই আছে। নেই লাল সবুজের সুজলা, সুফলা, শস্য-শ্যামলের বাংলাদেশ। ঈদ আছে। নেই ঈদের আনন্দ। এই খন্ড খন্ড হৃদয়ের চাওয়াগুলো প্রবাসের এতো চাকচিক্যের মাঝে মন ভরে না। ফিরে যেতে মন চায় মাটির টানে স্বদেশের আঙিনায়।

একদা আমরা যারা একসাথে চলেছি, একই বিদ্যালয়ে পড়েছি, তারাই আজ ছড়িয়েছি, ছিটিয়েছি পৃথিবীর একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে; অনেকটা সময়ের প্রয়োজনে। খানিকটা জীবনের দাবীও বটে। জীবনের প্রতি যে দায়বদ্ধতা- তা থেকে একজন দায়িত্ববান মানুষের পালানো সত্যি অসম্ভব, তাই জড়িয়েছি জীবন নামের কাঠিন্যের সাথে।

জীবনের পথ পরিক্রমায় যতটা না দৃষ্টির সীমানা ছেড়ে দূরে গিয়েছি প্রিয় সব মানুষগুলোকে ছেড়ে, প্রিয় জনপদ রেখে, মনে হয় প্রতিদিন সমাধিক কাছে এসেছি আত্মার পথে, ভালোবাসার পথে, ভালোলাগার জন্য। এ এক নিরেট ভালোলাগা, যা সম্পূর্ণ আত্মিক আত্মীয়তায় সমৃদ্ধ।

কখনো কখনো এই প্রবাসকে আনমনে আপন করি, করতে হয়। আপন ভাবি, ভাবতে হয়। আমাদের খুব সুযোগও নেই এই ভাবনা থেকে বের হবার!
বিদেশ বিভূয়ে তাই সর্বদা প্রাণ কেঁদে উঠে আমার রূপসী বাংলার জন্যে, যেথায় আমার জীবন নামক স্রোতস্বিনীর স্বর্ণালী দিনগুলো বর্ণালী হয়েছিল নিজের মতো করে। সেই স্মৃতিমাখা দিনগুলোর কথা ভেবে ভেবেই একটি সুন্দর আর বিলাসী স্বপনের জাল বোনা যায় খুব।

মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে সব ছেড়ে পালাই আমার শ্যামলিয়ায়, প্রিয় স্বদেশে। কী হবে এই উন্নত জীবনের হাতছানি? কী হবে শতভাগ নাগরিক সুবিধা সমৃদ্ধ জীবন ব্যবস্থা দিয়ে? তাও কি সম্ভব? জীবন যে আমাকে ঘিরে রেখেছে কঠিন এক বাস্তবতায়। এতোসব বাস্তবতায়ও আমাদের এ প্রবাসী জীবনে আনন্দ, হাসি, কান্না, সুখ-দুঃখের সংমিশ্রণতো রয়েছেই।

তবুও আমরা ঈদ উদযাপন করি। পাঞ্জাবী-পায়জামা আর বাহারী সব নুতন জামা পরে ঈদের আনন্দ অন্বেষণে ব্যস্ত হই।

শত অপূর্ণতায়ও প্রবাসী অন্তরাত্মা বলে উঠেঃ

“জীবন যখন বদ্ধখাঁচায় আকাশে ঈদের চাঁদ
কারো কারো ঘরে কান্নার ঢেউ
জীবনের কথা ভুলে গেছে কেউ
দাঁড় টেনে চলো আনতে সুদিন ভাঙ্গো সকল বাঁধ।”

Wednesday, June 14, 2017

“তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ।”

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) নবুয়ত লাভের পর মক্কায় ইসলাম ধর্ম প্রচার শুরু করেন। ইসলাম প্রচারের কারণে কুরাইশরা মহানবি (সাঃ) ও তাঁর সাহাবাদের (রাঃ) উপর নির্মম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। নির্যাতনের পরও মহানবি (সাঃ) দ্বীনের দাওয়াত চালিয়ে যেতে থাকলে কুরাইশরা এক পর্যায়ে মহানবি (সাঃ) কে হত্যা করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় আল্লাহর আদেশক্রমে মহানবি (সাঃ) হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) কে সাথে নিয়ে ইসলামের শক্রদের চোখ ফাঁকি দিয়ে ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে সেপ্টেম্বর মাতৃভূমি মক্কা ত্যাগ করে মদিনায় হিজরত করেন।

মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা থেকে হিজরত করে মদিনায় আসছেন এই সংবাদ পেয়ে মদিনাবাসী আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠেন। প্রতিদিন দলে দলে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মদিনা থেকে তিন মাইল দূরে অবস্থিত কুবা পল্লীর হাররা নামক স্থানে জড়ো হতে লাগলেন এবং তাঁর জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন। কিন্তু তাঁকে না দেখে সবাই হতাশ হয়ে ফিরে যেতেন। একদিন এক ইহুদী দূর্গ প্রাচীরে উঠে বহু দূরে ধূলি উড়তে দেখে চিৎকার দিয়ে মদিনাবাসীকে হযরত মহানবি (সাঃ) এর আগমনের সু- সংবাদ জানায়। সাথে সাথে মদিনাবাসী আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠে এবং মহানবি (সাঃ) কে সাদরে বরণ করে নেন।

মদিনায় হিজরত করে নবি করিম (সাঃ) সর্বপ্রথম আমর ইবনে আওফের গোত্রপতি কুলসুম ইবনুল হিদমের আতিথ্য গ্রহণ করেন। মহানবি (সাঃ) এখানে ১৪ দিন অবস্থান করেন। এখানে অবস্থানকালে তিনি কুলসুম ইবনুল হিদম (রাঃ) এর খেজুর শুকানোর পতিত জমিতে মসজিদে কুবা তৈরী করেন। মসজিদে কুবা তাকওয়ার উপর প্রতিষ্ঠিত প্রথম মসজিদ। মসজিদে হারাম, মসজিদে নববী এবং মসজিদে আকসার পরই মসজিদে কুবার সম্মান। পবিত্র কুরআনের সুরা তাওবার ১০৮ নং আয়াতে এই মসজিদের কথা উল্লেখ আছে। মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেন “যে মসজিদ প্রথম দিন থেকেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাকওয়ার উপর (মসজিদে কুবা) -তাই বেশী হকদার যে, তুমি সেখানে সালাত কায়েম করতে দাঁড়াবে। সেখানে এমন লোক আছে, যারা উত্তমরূপে পবিত্রতা অর্জন করতে ভালবাসে। আর আল্লাহ পবিত্রতা অর্জনকারীদের ভালবাসেন।”
মসজিদে কুবা প্রথম নির্মাণ থেকে এ পর্যন্ত কয়েক দফা সংস্কার ও পূণঃনির্মাণ করা হয়। মহানবি (সাঃ) এর পর ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রাঃ) তাঁর খিলাফতকালে সর্বপ্রথম মসজিদে কুবার সংস্কার ও পূণঃনির্মাণ করেন। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরো সাত বার এই মসজিদের পূণঃনির্মাণ ও সংস্কার করা হয়। অনেক পুরোনো ও জীর্ণ হয়ে যাওয়ার পর সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে মসজিদটি পূণঃনির্মাণ করা হয়। এই মসজিদ নির্মাণে পুরো মসজিদে এক ধরনের সাদা পাথর ব্যবহার করা হয়।
চার মিনার ও দোতলা বিশিষ্ট মসজিদে কুবার ছাদে ১টি বড় গম্বুজ এবং ৫টি অপেক্ষাকৃত ছোট গম্বুজ রয়েছে। তাছাড়া ছাদের অন্য অংশে আছে গম্বুজের মতো ছোট ছোট অনেক অবয়ব। পাশে আছে হরিৎ খেজুরের বাগান যা দেখলে চোখ জুড়ে যায়। হলদে বিকেলে দূর থেকে মসজিদটি দেখলে হৃদয় ভরে যায়।

মসজিদে নববীর দক্ষিণ পশ্চিম দিকে অবস্থিত এই মসজিদের দূরত্ব মসজিদে নববী থেকে ৩.২৫ কিঃ মিঃ। মদিনায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ১০ বছর কাটিয়েছেন, এ সময়ে রাসুলুল্লাহ (সাঃ) পায়ে হেঁটে অথবা উটে আরোহণ করে কুবা মসজিদে যেতেন। এরপর তিনি সেখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করতেন। হাদিস শরিফের বর্ণনায় আছে যে, “মদিনার জীবনে মহানবি (সাঃ) প্রত্যেক শনিবার কখনো পায়ে হেঁটে, আবার কখনো উটে আরোহন করে মসজিদে কুবায় তাশরিফ আনতেন।” প্রখ্যাত সাহাবি হযরত উসাইদ ইবনে হুজাইব আল আনসারী (রাঃ) বর্ণনা করেন, মহানবি (সাঃ) এরশাদ করেছেন “মসজিদে কুবায় এক ওয়াক্ত নামায আদায় করা সওয়াবের দিক থেকে একটি উমরার সমতুল্য।” (তিরমিযি)

মসজিদে কুবার এই সম্মান ও মর্যাদার কারণে মহানবি (সাঃ) এর ইন্তিকালের পরও বিশিষ্ট সাহাবায়ে কিরামগণ (রাঃ) মহানবি (সাঃ) এর অনুকরণে প্রায়ই মসজিদে কুবায় আসতেন ও তাতে নামায আদায় করতেন। মহানবি (সাঃ)’র অনুসরণে এখানে আগমন করা ও দু’রাকাত নামাজ আদায় করা মোস্তাহাব।

Tuesday, June 13, 2017

“খেজুর আর উটের দেশের স্বপ্নময় দিনগুলো।”

গরমটা ধীরে ধীরে বেশ বাড়ছেই, বৃষ্টির হঠাৎ কোমল স্পর্শ পাওয়ার আশায় সকলেই ব্যাকুল। কিন্তু মরুভূমির লু হাওয়া আর তপ্ত বালির কথা মনে পড়লে এ সবকিছুই তুচ্ছ মনে হয়। সে যাইহোক, এক ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলিম যুবক হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র মক্কা নগরী, মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর রওজা মুবারকের শহর মদিনা সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান সফর করার। অভিজ্ঞতার ঝুলিটা পূর্ণ হলো মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য বিজয়ের কৃষ্টি আর সে দেশের সহজ-সরল মানুষগুলোর আন্তরিকতাপূর্ণ হৃদয়গুলোর উষ্ণ আলিঙ্গনে।

গত শনিবার রাত ১০.১৫ টার দিকে রিয়াদ থেকে রওয়ানা হয়ে পরদিন সকাল ৭.০০ ঘটিকায় পৌঁছে গেলাম প্রাণের শহর মদিনা মুনাওয়ারায়। সুপ্রাচীন মদিনা শহরে আমাদের প্রাণপ্রিয় মহানবি (সাঃ)’র রওজা মুবারক হাতছানি দিয়ে ঢাকছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে দীর্ঘ ভ্রমণ পথে ধূ ধূ বালির মরুভূমি, মরুর বুকে মাঝে মাঝে উঁকি দেওয়া সবুজ ক্যাকটাসের ঝোঁপ, হলদে খেঁজুরের দিগন্তবিস্তৃত বাগান, পাথরের পাহাড় আর মরুভূমির জাহাজ উটের পাল যেন এক দক্ষ শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা ছবি।

মদিনায় পৌঁছে হোটেলে এসেই বিশ্রাম না নিয়ে ছুটে যাই মসজিদে নববীতে। সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় মসজিদে নববীতে ঘড়ির কাঁটা মেপে সবকিছু চলছে। সবদিক ঘুরে ঘুরে দেখে যোহরের নামাজ আদায় শেষে রাসূলে আকরাম (সাঃ), হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)’র রওজা মুবারক যিয়ারতে মনের মধ্যে শান্তির পরশ পাই।
বলা অত্যাবশ্যক যে, মদিনা শহরটি মক্কার একেবারে বিপরীত দিকে অবস্থিত। সুসজ্জিত আলো ঝলমলে মদিনা নগরী, গগনচুম্বী সুনির্মিত দালানগুলো, বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেলগুলোর ক্রমশ সাম্রাজ্য বিস্তার, ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী ওহুদ যুদ্ধের পাহাড়, প্রিয়নবি মুহাম্মদ (সাঃ)’র হিজরতের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদে কুবা, মসজিদে নববী, হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও নবি (সাঃ)’র দুধ মা হযরত হালিমা সাদিয়া (রাঃ) সহ নাম না জানা কত শত সাহাবীর অমলিন স্মৃতির সাক্ষর জান্নাতুল বাকি, ইফতারে সৌদিবাসীর অতি প্রিয় খাবার ‘মানদী’, শান্ত অতিথিপরায়ণ মদিনাবাসীর আন্তরিকতা! সময়গুলো কি অদ্ভুত শিহরণে কেটে গেল এতটুকু টের পাইনি।
মসজিদে নববীতে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে মদিনায় সময়ের পাল্লা শেষ হয়ে এলো। এবার ওমরাহ পালনের নিয়্যাতে পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে মদিনা থেকে ৬ মাইল দক্ষিণে ‘যুল হোলায়ফা’ নামক মীকাতে গোসল শেষে ওমরাহর নিয়্যাতে ইহরামের কাপড় পরিধান করতঃ তালবিয়াহ পাঠ শুরু করি। পরবর্তীতে এশার নামাজ আদায়ের পর আবার রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে সেহরি গ্রহণ করে ঠিক ফজরের ওয়াক্তে পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছালাম।

মক্কা নগরীর প্রবেশ মুখটি বিশাল, প্রবেশ পথে কালো গ্রানাইট পাথরের তৈরী পাহাড়গুলোর উপর অবস্থিত ছোট ছোট অসংখ্য বসতি পর্যটকদের দৃষ্টি টানে। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দোকান, খাবার আসবাবপত্র আর মনোহর সব জিনিসের পসরা সাজিয়ে রেখেছে দোকান মালিকরা, যাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। সৌদি সরকারের ভাষ্য মতে, প্রায় পঁচিশ লাখ বৈধ বাঙালির আবাস এখানে। অপরদিকে, অবৈধ অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা আনুমানিক ছয় থেকে সাত লক্ষ যারা প্রতিনিয়ত জীবনের বিপরীত স্রোতে বৈঠা টেনে চলেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ সৌদি সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয়ে আশ্রিত।
প্রতিদিন লাখ লাখ লোকের পদচারণায় পবিত্র মক্কা নগরী প্রকম্পিত হলেও আইন-শৃঙ্খলার দীর্ঘ শেকলটি আরো মজবুত হওয়া দরকার। ভীড়ের কারণে হাজীদের পদদলিত হওয়া, অসহ্য গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা, ভালো মানের হোটেলের অপ্রতুলতা প্রভৃতি। সৌদি সরকারের দূরদর্শী বিনিয়োগ ও সকলের সহযোগিতাই প্রতিদিনকার এ সমস্যাটিকে সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারে।

সোনালি অলংকরণের কালো চাদরে ঢাকা পরম পবিত্র আল্লাহর ঘরটি তাওয়াফের সুমধুর রবে প্রকম্পিত। ফজরের নামাজ মসজিদে হারামে আদায়ের পর ওমরাহর যাবতীয় কার্য সম্পাদন করি। আলহামদুলিল্লাহ, এ এক অন্যরকম অনুভূতি, যা কোন ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

ফিরে আসার সময় হয়ে এলো। পৃথিবীর ইতিহাসে সৌদি আরব দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের রাজত্ব ধরে রেখেছে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতা এ দু’য়ের সন্ধিক্ষণে দেশটি সামনে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু, ভিনদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ আর ব্যবসা প্রসারের নামে অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক স্থাপনা ক্রমশ ভেঙ্গে ফেলার যে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়াস সৌদি সরকারের, তা কতটুকু সঠিক সময়ই হয়তো বলে দিবে।

Wednesday, April 26, 2017

“সৌদি আরবে আমার দিনগুলো।”

দিনের পর সপ্তাহ পেরিয়ে দেখতে দেখতে মাস খানেকের অধিক সময় সৌদি আরবে কেটে গেলো। আলো ঝলমলে নগরীতে হাসি আছে, আনন্দ আছে, আছে দুঃখ ও বেদনা। রাতগুলো কারো কাছে যেমন দীর্ঘ, পাশাপাশি অনেকের কাছে তা খুবই ছোট। 
আমি দেখেছি- আরব বিশ্ব নিয়ে আমাদের প্রায় সবার মাঝেই মিশ্র অনুভূতি আছে। অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, ভালো মন্দে মেশানো যেকোন সমাজ। দিনশেষে আপনি নিজে কীভাবে নিজের জীবনটাকে দেখতে চেয়েছেন তাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
আমার এই অল্প সময়ে সৌদি আরবকে যেমনটা দেখেছি তার কিছু দিক হলো নিম্নরূপ—

✔ সালাম ও সালাতঃ

আমার এমনও হয়েছে ঢাকা হতে বাসে সিলেটে যাচ্ছি অথচ পাশের সিটের যাত্রীর সাথে একটি কথাও হয়নি। কিন্তু সৌদি আরবে এটা কল্পনাও করা যাবেনা। কেউ কাউকে চেনেনা- সালাম দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যাচ্ছে। সালাম দেয়ার সাথে সাথে তাদের মাঝের দূরত্ব দূর হয়ে যায়।
মরুভূমির মাঝ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, সালাতের সময় হয়ে গেলে সৌদিরা গাড়ি থামিয়ে মাদুর বিছিয়ে সালাত আদায় করে নেয়। তার দেখাদেখি অন্যান্য গাড়িগুলো থেমে যায়। এখানে হাইওয়েগুলোর পাশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্যাস স্টেশন, খাবার দোকান ও একটি মসজিদ থাকবেই। দু’জন লোক হলেই এরা জামাত বানিয়ে সালাত পড়বে। যদিও এখানে ধর্মীয় পুলিশ আছে, তারা সালাতের তাগাদা দেয়। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সালাত পড়াটা নিজের ভেতর থেকেই আসে।

✔ নিমন্ত্রণঃ

সাথে পরিবার না থাকলে কোন সৌদি খাচ্ছে এবং আপনি তাকে সালাম দিলেন অথচ তার সাথে খেতে বলবেনা তা ভাবাই যায় না। কাউকে খাওয়ানোটা সওয়াবের কাজ। মসজিদগুলোতে অনেকেই পানির বাক্স রেখে যায় শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। শুনেছি রামাদ্বানের সময় পানি দান করাটা অনেক বেড়ে যায়। পৌর অফিস রাস্তার পাশে শহর জুড়ে রেফ্রিজারেটর বসিয়েছে-সৌদিরা সেখানে খাবার, ফলমূল, জুস ও পানি রেখে দেয় যাতে যে কেউ প্রয়োজনমত নিয়ে খেতে পারে।

✔ সাহায্য প্রাপ্তিঃ

আমি আরবি ভাষায় পারদর্শী নই, আবার সৌদিরা ইংরেজিতে খুব একটা সামলে উঠতে পারেনা; অথচ তারা অনেকেই সাহায্যপরায়ণ। ঠিকমতো বুঝাতে পারলে সাহায্য করবেই। আমার প্রথম দিনে বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পাসপোর্টে আরবিতে বর্ডার নম্বর ভুল লিখে ফেলেন। কিন্তু আমি যখন STC SIM Card কিনতে যাই তখনই তা অপারেটিং কর্মকর্তার নজরে আসে এবং তিনি আমাকে ইমিগ্রেশন ডেস্ক থেকে পূণরায় নম্বরটির সঠিকতা যাচাই করতে ইমিগ্রেশন পুলিশের নিকট নিয়ে যান। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তায় আমার পাসপোর্টে বর্ডার নম্বর সঠিকভাবে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা লিখে দেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

✔ সস্তা খাবারঃ

সৌদি আরবে জীবন যাপনের ব্যয়ভার খুবই কম। এখানকার চেয়ে সস্তা খাবার আর কোথাও পাওয়া যাবেনা। তেলের দাম কম হওয়ায় আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর খরচই কমে যায়। ১ রিয়ালে ৪ টি রুটি অথবা ১টি বিশাল সাইজের আফগানি রুটি (তমিজ) পাওয়া যায়। কেউ ন্যূনতম ৩ রিয়াল খরচ করলে খুব সহজেই পেট ভরে নাস্তা করতে পারবে। বিভিন্ন দেশের লোক থাকার কারণে সব দেশের খাবারই এখানে পাওয়া যায়।
তবে সৌদিদের মতো খাবারের অপচয় আর কোন জাতি করে কিনা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

✔ উপভোগ্য জীবনঃ

অলসদের তালিকায় সৌদি আরব তৃতীয় হয়েছিল। এদের মতো চিন্তামুক্ত জীবন বোধহয় কেউ যাপন করেনা। ১৫ জন ধরে এমন আকারের জিএমসি গাড়ি নিয়ে বাসা হতে বের হয়ে যাবে, রাস্তার ধারে কিংবা পার্কে বসে পরিবারের লোকজনের সাথে অলস সময় কাটাবে। সামাজিক নিরাপত্তা থাকার কারণে হাতে যা টাকা আসে, সবটাই প্রায় খরচ করে ফেলে।
লং ড্রাইভ, রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে শিসা টানা এদের শখ।

✔ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ

টাকা থাকলেই যে তার সঠিক ব্যবহার হবে তা নয়। তবে সৌদি আরব তার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই গড়ে তুলেছে। সৌদি আরবে এখন মেট্রোরেলের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। তাছাড়া এখানে একটি গ্রামের রাস্তা ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের চেয়েও ভালো। হাইওয়েতে একেক পাশেই ৮টি করে লেইন থাকে। যদিও সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু তা হাতের নাগালেই। সবাই গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। পাহাড় পেড়িয়ে সমূদ্রের তীরে ভীড় লেগেই থাকে।

✔ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যঃ 

আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই কয়দিনে সৌদি আরবের রিয়াদে বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখার- আদ দিরাহে অবস্থিত মাসমাক দুর্গ, কিংডম সেন্টার, আল ফায়সালিয়াহ টাওয়ার, লুলু হাইপার মার্কেট, বাথহা মার্কেট ইত্যাদি। তবে ভ্রমণ বিধিনিষেধ থাকার কারণে বহিঃবিশ্বের পর্যটকেরা সব জায়গা খুব একটা এক্সপ্লোর করতে পারেনা। তাই জায়গাগুলো এখনো প্রকৃতির আদি রুপেই আছে। মরুর সৌন্দর্য্য, ওয়াদি, বুনো ঝোপ, নগরায়ণ সব কিছুই নতুন ভ্রমণপিপাসুদের নয়ন জুড়াবে তাতে সন্দেহ নেই।

✔ নিজের জন্য অঢেল সময়ঃ

আমার ইকামা এখনোও হাতে পাইনি বিধায় অফিসের কাজকর্ম শুরু করতে পারিনি। তাই বাসায় বসে বসে অন্তর্জালে সময় ক্ষেপনের জন্য বিস্তর সময় থাকে। তার উল্টোপিঠে অনেকেই সময়কে খুঁজে পায় না, কিছু করার জন্য সময় হাতড়ে বেড়ায়। এরা আসলে তারুণ্যের মায়াজালে বৃদ্ধের প্রতিরূপ। সময় কখনো থেমে থাকে না। অঢেল এ সময়কে আমরা কতটুকু সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি?

✔ মক্কা ও মদীনাঃ

ইসলাম ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য মক্কামদীনা তাঁদের চিন্তা ও চেতনায় বিশাল জায়গা জুড়ে থাকে। সৌদি আরবে যারা থাকেন স্বভাবতই তারা অন্যদের তুলনায় এ স্থান দু’টিতে ইবাদাতের জন্য বেশী বেশী ভ্রমণ করার সুযোগ পান। মক্কা ও মদীনা হৃদয়কে আলোড়িত করে, শুদ্ধভাবে বেঁচে থাকার পথ দেখায়।

আমার মনের গহীনে লালিত স্বপ্ন- মক্কা ও মদীনা ভ্রমণ বাস্তবে পরিণত হবে (ইনশা’আল্লাহ) সে আশায় প্রহর গুণছি।

Sunday, February 12, 2017

উমরা কীভাবে করবেনঃ (كيف تعتمر)


হজ্জ বা উমরার ইবাদাতে প্রবেশের নিয়ত করাই হচ্ছে ইহরাম। সে হিসেবে প্রথমে ইহরামের কাপড় পরবে, অতঃপর নিয়ত করবে। উমরা হলে উমরার নিয়ত, আর হজ্জ করলে হজ্জের নিয়ত।
পুরুষের ইহরামের কাপড়টি চাদরের মতো দু’টুকরো কাপড়ের ১ টি নিচে ও অপরটি গায়ে পরিধান করবে। সাদা রঙ উত্তম।
উমরার কাজ ৪ টি, এগুলো হলোঃ (১) ইহরাম বাঁধা (২) বায়তুল্লাহ তাওয়াফ করা (৩) সাঈ’ করা (৪) মাথা মুন্ডানো বা চুল ছাঁটা।
হজ্জ ও উমরা পালনকারীদের জন্য মক্কার চারপাশে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকটি সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। হজ্জ ও উমরার জন্য যেসব জায়গা থেকে ইহরাম বাঁধতে হয়, এ জায়গাগুলোকে বলা হয় ‘মীকাত’।
বাংলদেশ থেকে বিমানে করে যারা জেদ্দায় যান তারা যে মীকাত অতিক্রম করেন তা হলো ‘কারনুল মানাযিল’। উক্ত ‘কারনুল মানাযিল’ অতিক্রম করার আগেই ইহরামের কাপড় পরে উমরার নিয়ত করে ফেলবেন। নিয়ত মনে মনে করবেন, আর মুখেও উচ্চারণ করবেন, اللهم لبيك عمرة،  
(বাংলা উচ্চারণঃ আল্লাহুম্মা লাব্বাইকা উমরা)   কাপড় পরিধান ও নিয়ত – এ দু’টো কাজ সমাপ্ত করলে ইহরাম করা হয়ে যায়।
এবার তালবিয়্যাহ পড়তে থাকুন। তালবিয়্যাহ হলোঃ
 لبيك اللهم لبيك، لبيك لا شريك لك لبيك، أن الحمد والنعمة لك والملك، لا شريك لك،
মসজিদে হারামে ঢুকার পরপরই তালবিয়্যাহ পড়া বন্ধ করুন।
মসজিদে হারামে প্রবেশকালে ডান পা আগে দিয়ে পড়ুনঃ
أعوذ باالله العظيم وبوجهه الكريم، وسلطانه القديم من الشيطان الرجيم بسم الله والصلاة والسلام على رسول الله اللهم افتح لي أبواب رحمتك،
আর হারাম শরীফ থেকে বের হওয়ার সময় পড়বেনঃ
بسم الله والصلاة والسلام على رسول الله، اللهم إني اسألك من فضلك،
মসজিদে হারামে প্রবেশের পর তাওয়াফের শুরুতেই পুরুষেরা ইদ্তিবা করবেন। ইহরামের গায়ের কাপড়টি এক মাথা ডান বগলের নিচ দিয়ে এমনভাবে পেচিয়ে দেবেন, যাতে ডান কাঁধ, বাহু ও হাত খোলা থাকে। কাপড়টির বাকি অংশ ও উভয় মাথা দিয়ে বাম কাঁধ ও বাহু ঢেকে ফেলবেন। এটাকেই বলা হয় ইদ্তিবা। তাওয়াফের সময় ছাড়া আর কখনো ইদ্তিবা নেই। অন্য সময় বরং দু’কাঁধ ঢেকে রাখা সুন্নাত। তাছাড়া নামাযের সময় দু’কাঁধ ঢেকে রাখা অত্যাবশ্যক।
কাবাঘরকে বামপাশে রেখে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করে বা চুমু দিয়ে তাওয়াফ শুরু করবেন এবং এখানে এসেই শেষ করবেন। কেউ ভিড়ের কারণে হাজারে আসওয়াদ স্পর্শ করতে না পারলে হাত দ্বারা ইশারা করবে। উক্ত কালো পাথরের কোণা বরাবর মসজিদে হারামের দেয়ালে বৈদ্যুতিক সবুজ বাতি দেওয়া আছে। এ সীমানা বরাবর থেকে উভয় হাত কাঁধ পর্যন্ত উত্তোলন করে তাকবীর বলে নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করে তাওয়াফ শুরু করে আবার এখানে ফিরে এলে এক চক্কর শেষ হয়। এভাবে ৭ চক্কর পূর্ণ করতে হয়। আর তাওয়াফের ৭ চক্করের মধ্যে প্রথম ৩ চক্করে কাঁধ হেলিয়ে সজোরে বীর দর্পে ঘন ঘন পা ফেলে একটু দ্রুতগতিতে প্রদক্ষিণ করতে হয়। এটাকে শরীয়াতের পরিভাষায় ‘রমল’ বলে। বাকি ৪ চক্কর সাধারণভাবে হাঁটবেন।
দোয়াঃ
اللهم إيمانا بك، وتصديقا بكتابك، ووفاء بعهدك، وأتباعا لسنة نبيك محمد صلى الله عليه وسلم،
হাজারে আসওয়াদের কোণা থেকে তাওয়াফ শুরু করলে কাবা ঘরের চতুর্থ কোণটি হবে ‘রুকনে ইয়ামানী’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতি চক্করেই এটা স্পর্শ করতেন। রুকনে ইয়ামানী ও হাজারে আসওয়াদের মধ্যবর্তী জায়গায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিচের এ দোয়াটি পড়তেনঃ
ربنا آتنا في الدنيا حسنة وفي الآخرة حسنه وقنا عذاب النار،
তাওয়াফের সময় সবচেয়ে বড় ইবাদাত হলো দোয়া করা। কুরআন তিলাওয়াত করা, যিকর-আযকার ও তাওবা-ইস্তিগফার করাও সুন্নাত।
তাওয়াফ শেষ হলে দু’কাঁধ ও বাহু ইহরামের কাপড় দিয়ে আবার ঢেকে ফেলুন এবং মাকামে ইবরাহীম’র কাছে গিয়ে পড়ুনঃ
واتخذوا من مقام إبراهيم مصلي،   (سورة البقرة: ١٤٥)
অতঃপর মাকামে ইবরাহীমের পেছনে দু’রাকাত সালাত আদায় করুন। এখানে মানুষের ভিড় থাকলে মসজিদে হারামের যেকোনো জায়গায় নামায পড়া জায়েয আছে। ইমামে আযম আবু হানিফা (রহঃ) ও ইমাম মালেক (রহঃ) এর মতে, এটি ওয়াজিব নামায, আর ইমাম শাফেয়ী (রহঃ) ও ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহঃ) এর মতে, তা সুন্নাত। প্রথম রাকাতে সূরা আল-ফাতিহা পড়ার পর সূরা আল-কাফিরুন ও দ্বিতীয় রাকাতে সূরা আল-ফাতিহা পড়ার পর সূরা আল-ইখলাছ পড়া সুন্নাত। উল্লেখ্য যে, তিনটি নিষিদ্ধ ওয়াক্তেও এ দু’রাকাত নামায আদায় করা জায়েয আছে। অতঃপর যমযমের পানি দাঁড়িয়ে পান করুন, আর কিছু পানি আপনার মাথায় ঢালুন, যাতে আপনার চেহারার উপর দিয়ে তা গড়িয়ে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এ কাজটি করতেন।
এরপর সাফা পাহাড়ে চলে যান সাঈ’ শুরু করার জন্য। কাবা ঘরের পার্শ্বস্থ সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝে দৌড়ানোকে সাঈ’ বলে। সাঈ’র প্রথমেই সাফা পাহাড়ে উঠবেন। সেখানে এ আয়াতটি পড়া সুন্নাত,
أن الصفا والمروة من شعائر الله،  (سورة البقره: ١٥٨)
তারপর কিবলামুখী হয়ে সাফা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে নিম্নের এ যিকরটি পাঠ করা সুন্নাতঃ
لا اله الا الله وحده لاشريك له، له الملك وله الحمد يحيى ويمت وهو على كل شيء قدير، لا اله الا الله وحده أنجز وعده ونصر عبده وهزم الأحزاب وحده،
এই যিকরটি পাঠ করার পর দু’হাত উঠিয়ে দোয়া করবেন।
সাফা ও মারওয়া পাহাড়দ্বয়ের মাঝের অংশে আনুমানিক ১০০ গজ এলাকা দু’টি সবুজ বাতি দ্বারা চিহ্নিত করা আছে। এ স্থানকে ‘মায়লাইন আল আখদারাইন’ (দুই সবুজ ফলক) বলা হয়। এ জায়গাটুকুতে ‘রমল’ করা অর্থাৎ হেলে দুলে দৌড়ানো পুরুষের জন্য সুন্নাত। দৌড়ানোর সময় সে অংশে পড়বেনঃ
رب اغفر وارحم انك انت الاعز الأكرم،
সাফা পাহাড় থেকে মারওয়া পাহাড়ে গেলে এক চক্কর হয়, আবার মারওয়া পাহাড় থেকে সাফা পাহাড়ে ফিরে এলে আরেক চক্কর হয়। এভাবে ৭ চক্কর পূর্ণ করবেন।
৭ চক্কর শেষ হলে পুরুষেরা মাথা মুন্ডন করবেন। এখন আপনার উমরা শেষ হয়ে গেল। ইহরাম অবস্থায় যেসব কাজ নিষিদ্ধ ছিল সেগুলো এখন হালাল হয়ে গেল। ইহরামের পোশাক বদলিয়ে এবার আপনি যেকোনো কাপড় পরিধান করতে পারেন।