Wednesday, April 26, 2017

“সৌদি আরবে আমার দিনগুলো।”

দিনের পর সপ্তাহ পেরিয়ে দেখতে দেখতে মাস খানেকের অধিক সময় সৌদি আরবে কেটে গেলো। আলো ঝলমলে নগরীতে হাসি আছে, আনন্দ আছে, আছে দুঃখ ও বেদনা। রাতগুলো কারো কাছে যেমন দীর্ঘ, পাশাপাশি অনেকের কাছে তা খুবই ছোট। 
আমি দেখেছি- আরব বিশ্ব নিয়ে আমাদের প্রায় সবার মাঝেই মিশ্র অনুভূতি আছে। অস্বীকার করার কোন জো নেই যে, ভালো মন্দে মেশানো যেকোন সমাজ। দিনশেষে আপনি নিজে কীভাবে নিজের জীবনটাকে দেখতে চেয়েছেন তাই বড় হয়ে দাঁড়ায়।
আমার এই অল্প সময়ে সৌদি আরবকে যেমনটা দেখেছি তার কিছু দিক হলো নিম্নরূপ—

✔ সালাম ও সালাতঃ

আমার এমনও হয়েছে ঢাকা হতে বাসে সিলেটে যাচ্ছি অথচ পাশের সিটের যাত্রীর সাথে একটি কথাও হয়নি। কিন্তু সৌদি আরবে এটা কল্পনাও করা যাবেনা। কেউ কাউকে চেনেনা- সালাম দিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলে যাচ্ছে। সালাম দেয়ার সাথে সাথে তাদের মাঝের দূরত্ব দূর হয়ে যায়।
মরুভূমির মাঝ দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে, সালাতের সময় হয়ে গেলে সৌদিরা গাড়ি থামিয়ে মাদুর বিছিয়ে সালাত আদায় করে নেয়। তার দেখাদেখি অন্যান্য গাড়িগুলো থেমে যায়। এখানে হাইওয়েগুলোর পাশে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্যাস স্টেশন, খাবার দোকান ও একটি মসজিদ থাকবেই। দু’জন লোক হলেই এরা জামাত বানিয়ে সালাত পড়বে। যদিও এখানে ধর্মীয় পুলিশ আছে, তারা সালাতের তাগাদা দেয়। কিন্তু রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে সালাত পড়াটা নিজের ভেতর থেকেই আসে।

✔ নিমন্ত্রণঃ

সাথে পরিবার না থাকলে কোন সৌদি খাচ্ছে এবং আপনি তাকে সালাম দিলেন অথচ তার সাথে খেতে বলবেনা তা ভাবাই যায় না। কাউকে খাওয়ানোটা সওয়াবের কাজ। মসজিদগুলোতে অনেকেই পানির বাক্স রেখে যায় শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায়। শুনেছি রামাদ্বানের সময় পানি দান করাটা অনেক বেড়ে যায়। পৌর অফিস রাস্তার পাশে শহর জুড়ে রেফ্রিজারেটর বসিয়েছে-সৌদিরা সেখানে খাবার, ফলমূল, জুস ও পানি রেখে দেয় যাতে যে কেউ প্রয়োজনমত নিয়ে খেতে পারে।

✔ সাহায্য প্রাপ্তিঃ

আমি আরবি ভাষায় পারদর্শী নই, আবার সৌদিরা ইংরেজিতে খুব একটা সামলে উঠতে পারেনা; অথচ তারা অনেকেই সাহায্যপরায়ণ। ঠিকমতো বুঝাতে পারলে সাহায্য করবেই। আমার প্রথম দিনে বিমান বন্দরে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা পাসপোর্টে আরবিতে বর্ডার নম্বর ভুল লিখে ফেলেন। কিন্তু আমি যখন STC SIM Card কিনতে যাই তখনই তা অপারেটিং কর্মকর্তার নজরে আসে এবং তিনি আমাকে ইমিগ্রেশন ডেস্ক থেকে পূণরায় নম্বরটির সঠিকতা যাচাই করতে ইমিগ্রেশন পুলিশের নিকট নিয়ে যান। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তায় আমার পাসপোর্টে বর্ডার নম্বর সঠিকভাবে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা লিখে দেন এবং অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।

✔ সস্তা খাবারঃ

সৌদি আরবে জীবন যাপনের ব্যয়ভার খুবই কম। এখানকার চেয়ে সস্তা খাবার আর কোথাও পাওয়া যাবেনা। তেলের দাম কম হওয়ায় আনুষঙ্গিক অনেক কিছুর খরচই কমে যায়। ১ রিয়ালে ৪ টি রুটি অথবা ১টি বিশাল সাইজের আফগানি রুটি (তমিজ) পাওয়া যায়। কেউ ন্যূনতম ৩ রিয়াল খরচ করলে খুব সহজেই পেট ভরে নাস্তা করতে পারবে। বিভিন্ন দেশের লোক থাকার কারণে সব দেশের খাবারই এখানে পাওয়া যায়।
তবে সৌদিদের মতো খাবারের অপচয় আর কোন জাতি করে কিনা যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ আছে।

✔ উপভোগ্য জীবনঃ

অলসদের তালিকায় সৌদি আরব তৃতীয় হয়েছিল। এদের মতো চিন্তামুক্ত জীবন বোধহয় কেউ যাপন করেনা। ১৫ জন ধরে এমন আকারের জিএমসি গাড়ি নিয়ে বাসা হতে বের হয়ে যাবে, রাস্তার ধারে কিংবা পার্কে বসে পরিবারের লোকজনের সাথে অলস সময় কাটাবে। সামাজিক নিরাপত্তা থাকার কারণে হাতে যা টাকা আসে, সবটাই প্রায় খরচ করে ফেলে।
লং ড্রাইভ, রাত জেগে ফুটবল খেলা দেখতে দেখতে শিসা টানা এদের শখ।

✔ যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নঃ

টাকা থাকলেই যে তার সঠিক ব্যবহার হবে তা নয়। তবে সৌদি আরব তার যোগাযোগ ব্যবস্থা বেশ ভালোভাবেই গড়ে তুলেছে। সৌদি আরবে এখন মেট্রোরেলের কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। তাছাড়া এখানে একটি গ্রামের রাস্তা ঢাকা-সিলেট হাইওয়ের চেয়েও ভালো। হাইওয়েতে একেক পাশেই ৮টি করে লেইন থাকে। যদিও সম্প্রতি তেলের দাম কিছুটা বেড়েছে, কিন্তু তা হাতের নাগালেই। সবাই গাড়ি নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়। পাহাড় পেড়িয়ে সমূদ্রের তীরে ভীড় লেগেই থাকে।

✔ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যঃ 

আমার সৌভাগ্য হয়েছে এই কয়দিনে সৌদি আরবের রিয়াদে বেশ কিছু জায়গা ঘুরে দেখার- আদ দিরাহে অবস্থিত মাসমাক দুর্গ, কিংডম সেন্টার, আল ফায়সালিয়াহ টাওয়ার, লুলু হাইপার মার্কেট, বাথহা মার্কেট ইত্যাদি। তবে ভ্রমণ বিধিনিষেধ থাকার কারণে বহিঃবিশ্বের পর্যটকেরা সব জায়গা খুব একটা এক্সপ্লোর করতে পারেনা। তাই জায়গাগুলো এখনো প্রকৃতির আদি রুপেই আছে। মরুর সৌন্দর্য্য, ওয়াদি, বুনো ঝোপ, নগরায়ণ সব কিছুই নতুন ভ্রমণপিপাসুদের নয়ন জুড়াবে তাতে সন্দেহ নেই।

✔ নিজের জন্য অঢেল সময়ঃ

আমার ইকামা এখনোও হাতে পাইনি বিধায় অফিসের কাজকর্ম শুরু করতে পারিনি। তাই বাসায় বসে বসে অন্তর্জালে সময় ক্ষেপনের জন্য বিস্তর সময় থাকে। তার উল্টোপিঠে অনেকেই সময়কে খুঁজে পায় না, কিছু করার জন্য সময় হাতড়ে বেড়ায়। এরা আসলে তারুণ্যের মায়াজালে বৃদ্ধের প্রতিরূপ। সময় কখনো থেমে থাকে না। অঢেল এ সময়কে আমরা কতটুকু সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারছি?

✔ মক্কা ও মদীনাঃ

ইসলাম ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের জন্য মক্কামদীনা তাঁদের চিন্তা ও চেতনায় বিশাল জায়গা জুড়ে থাকে। সৌদি আরবে যারা থাকেন স্বভাবতই তারা অন্যদের তুলনায় এ স্থান দু’টিতে ইবাদাতের জন্য বেশী বেশী ভ্রমণ করার সুযোগ পান। মক্কা ও মদীনা হৃদয়কে আলোড়িত করে, শুদ্ধভাবে বেঁচে থাকার পথ দেখায়।

আমার মনের গহীনে লালিত স্বপ্ন- মক্কা ও মদীনা ভ্রমণ বাস্তবে পরিণত হবে (ইনশা’আল্লাহ) সে আশায় প্রহর গুণছি।