Tuesday, June 13, 2017

“খেজুর আর উটের দেশের স্বপ্নময় দিনগুলো।”

গরমটা ধীরে ধীরে বেশ বাড়ছেই, বৃষ্টির হঠাৎ কোমল স্পর্শ পাওয়ার আশায় সকলেই ব্যাকুল। কিন্তু মরুভূমির লু হাওয়া আর তপ্ত বালির কথা মনে পড়লে এ সবকিছুই তুচ্ছ মনে হয়। সে যাইহোক, এক ধর্মপ্রাণ সাধারণ মুসলিম যুবক হিসেবে আমার সৌভাগ্য হয়েছিল পবিত্র ওমরাহ পালনের উদ্দেশ্যে মুসলমানদের প্রাণকেন্দ্র পবিত্র মক্কা নগরী, মহানবি হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর রওজা মুবারকের শহর মদিনা সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থান সফর করার। অভিজ্ঞতার ঝুলিটা পূর্ণ হলো মধ্যপ্রাচ্যের এ দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, প্রাচ্য আর পাশ্চাত্য বিজয়ের কৃষ্টি আর সে দেশের সহজ-সরল মানুষগুলোর আন্তরিকতাপূর্ণ হৃদয়গুলোর উষ্ণ আলিঙ্গনে।

গত শনিবার রাত ১০.১৫ টার দিকে রিয়াদ থেকে রওয়ানা হয়ে পরদিন সকাল ৭.০০ ঘটিকায় পৌঁছে গেলাম প্রাণের শহর মদিনা মুনাওয়ারায়। সুপ্রাচীন মদিনা শহরে আমাদের প্রাণপ্রিয় মহানবি (সাঃ)’র রওজা মুবারক হাতছানি দিয়ে ঢাকছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়িতে দীর্ঘ ভ্রমণ পথে ধূ ধূ বালির মরুভূমি, মরুর বুকে মাঝে মাঝে উঁকি দেওয়া সবুজ ক্যাকটাসের ঝোঁপ, হলদে খেঁজুরের দিগন্তবিস্তৃত বাগান, পাথরের পাহাড় আর মরুভূমির জাহাজ উটের পাল যেন এক দক্ষ শিল্পীর নিপুণ তুলিতে আঁকা ছবি।

মদিনায় পৌঁছে হোটেলে এসেই বিশ্রাম না নিয়ে ছুটে যাই মসজিদে নববীতে। সুনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থাপনায় মসজিদে নববীতে ঘড়ির কাঁটা মেপে সবকিছু চলছে। সবদিক ঘুরে ঘুরে দেখে যোহরের নামাজ আদায় শেষে রাসূলে আকরাম (সাঃ), হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ) ও হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ)’র রওজা মুবারক যিয়ারতে মনের মধ্যে শান্তির পরশ পাই।
বলা অত্যাবশ্যক যে, মদিনা শহরটি মক্কার একেবারে বিপরীত দিকে অবস্থিত। সুসজ্জিত আলো ঝলমলে মদিনা নগরী, গগনচুম্বী সুনির্মিত দালানগুলো, বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেলগুলোর ক্রমশ সাম্রাজ্য বিস্তার, ইতিহাসের অন্যতম সাক্ষী ওহুদ যুদ্ধের পাহাড়, প্রিয়নবি মুহাম্মদ (সাঃ)’র হিজরতের স্মৃতি বিজড়িত মসজিদে কুবা, মসজিদে নববী, হযরত ফাতেমা (রাঃ) ও নবি (সাঃ)’র দুধ মা হযরত হালিমা সাদিয়া (রাঃ) সহ নাম না জানা কত শত সাহাবীর অমলিন স্মৃতির সাক্ষর জান্নাতুল বাকি, ইফতারে সৌদিবাসীর অতি প্রিয় খাবার ‘মানদী’, শান্ত অতিথিপরায়ণ মদিনাবাসীর আন্তরিকতা! সময়গুলো কি অদ্ভুত শিহরণে কেটে গেল এতটুকু টের পাইনি।
মসজিদে নববীতে মাগরিবের নামাজ আদায় শেষে মদিনায় সময়ের পাল্লা শেষ হয়ে এলো। এবার ওমরাহ পালনের নিয়্যাতে পবিত্র মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে মদিনা থেকে ৬ মাইল দক্ষিণে ‘যুল হোলায়ফা’ নামক মীকাতে গোসল শেষে ওমরাহর নিয়্যাতে ইহরামের কাপড় পরিধান করতঃ তালবিয়াহ পাঠ শুরু করি। পরবর্তীতে এশার নামাজ আদায়ের পর আবার রওয়ানা হয়ে পথিমধ্যে সেহরি গ্রহণ করে ঠিক ফজরের ওয়াক্তে পবিত্র মক্কা নগরীতে পৌঁছালাম।

মক্কা নগরীর প্রবেশ মুখটি বিশাল, প্রবেশ পথে কালো গ্রানাইট পাথরের তৈরী পাহাড়গুলোর উপর অবস্থিত ছোট ছোট অসংখ্য বসতি পর্যটকদের দৃষ্টি টানে। রাস্তার দু’পাশে সারি সারি দোকান, খাবার আসবাবপত্র আর মনোহর সব জিনিসের পসরা সাজিয়ে রেখেছে দোকান মালিকরা, যাদের একটি বড় অংশ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছে। সৌদি সরকারের ভাষ্য মতে, প্রায় পঁচিশ লাখ বৈধ বাঙালির আবাস এখানে। অপরদিকে, অবৈধ অভিবাসী বাঙালির সংখ্যা আনুমানিক ছয় থেকে সাত লক্ষ যারা প্রতিনিয়ত জীবনের বিপরীত স্রোতে বৈঠা টেনে চলেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম শরণার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ সৌদি সরকারের রাজনৈতিক আশ্রয়ে আশ্রিত।
প্রতিদিন লাখ লাখ লোকের পদচারণায় পবিত্র মক্কা নগরী প্রকম্পিত হলেও আইন-শৃঙ্খলার দীর্ঘ শেকলটি আরো মজবুত হওয়া দরকার। ভীড়ের কারণে হাজীদের পদদলিত হওয়া, অসহ্য গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত অবস্থা, ভালো মানের হোটেলের অপ্রতুলতা প্রভৃতি। সৌদি সরকারের দূরদর্শী বিনিয়োগ ও সকলের সহযোগিতাই প্রতিদিনকার এ সমস্যাটিকে সমাধানের পথ বাতলে দিতে পারে।

সোনালি অলংকরণের কালো চাদরে ঢাকা পরম পবিত্র আল্লাহর ঘরটি তাওয়াফের সুমধুর রবে প্রকম্পিত। ফজরের নামাজ মসজিদে হারামে আদায়ের পর ওমরাহর যাবতীয় কার্য সম্পাদন করি। আলহামদুলিল্লাহ, এ এক অন্যরকম অনুভূতি, যা কোন ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।

ফিরে আসার সময় হয়ে এলো। পৃথিবীর ইতিহাসে সৌদি আরব দীর্ঘ সময় ধরে তাঁদের রাজত্ব ধরে রেখেছে। ঐতিহ্য আর আধুনিকতা এ দু’য়ের সন্ধিক্ষণে দেশটি সামনে এগিয়ে চলার চেষ্টা করছে। কিন্তু, ভিনদেশী পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ আর ব্যবসা প্রসারের নামে অতি মূল্যবান ঐতিহাসিক স্থাপনা ক্রমশ ভেঙ্গে ফেলার যে অনাকাঙ্ক্ষিত প্রয়াস সৌদি সরকারের, তা কতটুকু সঠিক সময়ই হয়তো বলে দিবে।

No comments:

Post a Comment